আবহাওয়ার পরিবর্তনে কৃষিতে সর্বনাশ

এখন আবহাওয়ার গতি-প্রকৃতি বুঝে ওঠা দায়। প্রকৃতি বিচিত্র ধরনের আচরণ করছে। ক্ষণে ক্ষণে বদলাচ্ছে চরিত্র। যথাসময়ে শীত আসছে না, বৈশাখে আষাঢ়ের আচরণ, গরমে শীত শীতভাব, বর্ষায় বৃষ্টি কম, অতি খরা, অতি বৃষ্টি এমনটাই হচ্ছে। আবহাওয়ার এ ধরন দেখে বোঝার উপায় নেই প্রকৃতিতে কখন কোন ঋতু বিরাজ করছে দেশে। প্রকৃতির এমন আচরণে সবচেয়ে ক্ষতির কবলে পড়ছে দেশের কৃষি। বিজ্ঞানীরা বলছেন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সামনে প্রকৃতির এমন হেঁয়ালি আচরণ চলতেই থাকবে। আর কৃষির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত। তবে সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশের কৃষি এখনো ততটা আধুনিক হতে পারেনি। জলবায়ু সহিষ্ণু জাতের অভাব, যন্ত্রের উদ্ভাবন না হওয়া, কৃষিতে বিনিয়োগ না বাড়ানোসহ নানা কারণে কমছে উৎপাদন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃষিকে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্যকে টিকিয়ে রাখতে হবে। যত্ন নিতে হবে পরিবেশের। না বুঝে কৃষকেরাও পরিবেশের ক্ষতি করছেন দেদার। অপরিকল্পিত পুকুর খনন, রাসায়নিকের প্রয়োগ এবং যথেচ্ছভাবে চাষবাস সাময়িক উৎপাদন বৃদ্ধি করলেও সুদূরপ্রসারী ক্ষতিকর প্রভাব রেখে যাচ্ছে আগামী প্রজন্মের জন্য। এর জন্য মাটিও হারাচ্ছে তার উর্বরতা। তাই কৃষককেও পরিবেশ সংরক্ষণে নিরাপদ কৃষির জন্য সচেতন করে তুলতে হবে। টেকসই উন্নয়নের জন্য দেশের প্রতিজনকেই পরিবেশ সচেতন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার বিকল্প নেই।

এক সময় আকাশ দেখলেই কৃষক বলে দিতে পারতেন ঠিক কতক্ষণ পরে বৃষ্টি হবে। বাতাসে কান পাতলেই বুঝতেন এবারের বর্ষায় বৃষ্টি কতটুকু হবে। পুরোপুরি না মিললেও এই হিসাব-নিকাশগুলো কৃষককে কৃষিকাজে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সহযোগিতা করেছে দিনের পর দিন। কিন্তু জলবায়ুর পরিবর্তনের এই সময়ে এসে সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে গেছে। অসময়ের বৃষ্টি কিংবা রোদ বদলে দিয়েছে কৃষকের এত বছরের প্রকৃতির পাঠ। ফলে কৃষককেই মুখোমুখি হতে হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের কাছে। বলতে হচ্ছে, কৃষিই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। রোদ-বৃষ্টির চিরকালীন যে নিয়ম তা আর আগের মতো নেই। বীজ থেকে চারাও ঠিক আগের সময়ে গজাচ্ছে না। হিসাবগুলো সূক্ষ্ম হলেও প্রভাবটা অনেক বড়।

বেসরকারি সংগঠন পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার মাঠপর্যায়ের জরিপমতে, ২০১৭ সালের অকাল বন্যায় হাওরাঞ্চলের সাত জেলায় গড়ে ৭৫ ভাগ ফসল তলিয়ে যায়। এতে হাওরের কৃষকদের ২২ লাখ টন ধান এবং ১১ লাখ ৩৪ হাজার ৬০০টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রায় ২ হাজার টন মাছ, ৩০ হাজার হাঁস মারা গেছে এবং প্রায় ১ হাজার টন সবজি নষ্ট হয়েছে। সব মিলিয়ে অর্থের হিসাবে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা বলেছেন, আর মাত্র সাত দিন পর ঢল এলে এই ১৩ হাজার কোটি টাকা লোকসান হতো না।

শুধু হাওরাঞ্চলের কৃষকরাই নন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদসীমায় আছে সব কৃষক ও কৃষি খাত। এ বছর ডিসেম্বরে শীত পড়ার কথা থাকলেও ঝরেছে বৃষ্টি। ঘূর্ণিঝড় মিগজাউমের প্রভাবে টানা বৃষ্টি হয় ঢাকাসহ সারা দেশে। যেন বর্ষাকাল। আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়, এটি অসময়ের বৃষ্টি। অসময়ের এ বৃষ্টিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে পাকা আমন ধান ও রবি ফসলসহ শীতকালীন সবজির। নভেম্বরের মাঝামাঝিতে একইভাবে ঘূর্ণিঝড় মিধিলির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন চাষিরা। 

আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, এ বছর শীত পড়বে কম, স্থায়িত্বও বেশি দিন হবে না। বিষয়টি চিন্তিত করে তুলেছে দেশের কৃষি খাতসংশ্লিষ্টদের। শীতকালে আবহাওয়ার অস্বাভাবিক আচরণ আসন্ন রবি মৌসুমে বিভিন্ন ফসলে রোগবালাইয়ের প্রাদুর্ভাব বাড়ানোর পাশাপাশি সার্বিক উৎপাদন ব্যাহত করবে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।

জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী এম জাকির হোসেন খান বলেন, ‘নিনোর প্রভাবে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও ফসল উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। আবহাওয়া যেভাবে বিরূপ আচরণ করছে তাতে কৃষি খাতের ওপর প্রভাব পড়বে। আমাদের দেশে আবহাওয়ার আগাম সতর্কতার ক্ষেত্রে সক্ষমতা আরও বাড়ানো প্রয়োজন। যেন অঞ্চলভিত্তিক আলাদা পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন দুর্যোগের কারণে যেসব ফসলের ক্ষতি হচ্ছে সেসব কৃষককে সহায়তা দিতে হবে। সেটা ভর্তুকির মাধ্যমে হোক কিংবা বীমার মাধ্যমে। বিশেষ করে প্রান্তিক কৃষকদের সহায়তা দিতে হবে।’

বিভিন্ন সংস্থার প্রকাশিত তথ্য বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ। চলতি বছর হচ্ছে এই দশকের মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণতম বছর। চলতি মৌসুমে ঢাকায় ৫৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে চুয়াডাঙ্গায় ৪২ দশমিক ২ ডিগ্রি।

পর্তুগালের হুবেল কোম্পানি বর্তমান সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনকে বড় একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে। তাই তারা এখনই ভাবছে ২০ বছর পরের কৃষি নিয়ে। এ নিয়ে চলছে তাদের নানামুখী গবেষণাও। তারা মনে করছে, পর্তুগালের আগামীর কৃষির মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে সেচব্যবস্থা। সেচের পানি ভয়াবহরকম কমে আসছে। তাই তারা লবণাক্ত পানিসহিষ্ণু জাত তৈরির বিষয়ে গবেষণা করছে। এ ক্ষেত্রে বেশ সাফল্যও পেয়েছে। কিছু জাত তারা উদ্ভাবন করেছে, যেগুলোতে সেচ হিসেবে সমুদ্রের পানি দেওয়া যাবে। ভবিষ্যতে টেকনোলজিই হবে কৃষির প্রাণ।

কৃষিবিদ ড. মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, পরিবর্তনের প্রভাব কৃষিতে দৃশ্যমান এবং হুমকির মুখে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা। বীজ গজানো, পরাগায়ণ ও পরিপক্ব হতে সুনির্দিষ্ট তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত ও সূর্যালোকের প্রয়োজন। জলবায়ুর এ উপাদানগুলো পরিবর্ধিত হচ্ছে, কিন্তু বীজ বপন ও চারা রোপণের সময় পরিবর্তন সম্ভব হয়নি। ফলে কৃষি মৌসুমের সঙ্গে ফসলের চাষাবাদ খাপ খাওয়ানো যাচ্ছে না। 

এ অবস্থা হতে উত্তরণের জন্য পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মিল রেখে স্থানভিত্তিক গবেষণা কার্যক্রমকে জোরদার করতে হবে। তা ছাড়া পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আরও দুটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। একটি হলো প্রতিকূল পরিবেশে সহনশীল স্বল্পমেয়াদি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে ক্রমাগত বৃদ্ধিরত জনসংখ্যার জন্য খাদ্যের জোগান দেওয়া এবং অন্যটি পরিবর্তিত বিরূপ পরিবেশে কৃষিকে খাপ খাওয়ানো। ক্লাইমেট স্মার্ট প্রযুক্তি উদ্ভাবনের পাশাপাশি কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থাকে পরিবর্তিত জলবায়ুর সঙ্গে মিল রেখে টেকসই করতে খাপ খাওয়ানো বা অভিযোজন কৌশল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় তারা নতুন নতুন উদ্ভাবনী ধারণা তৈরি করছেন। সাতক্ষীরাসহ দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার মতো নতুন নতুন ধানের জাত উদ্ভাবন করা হচ্ছে।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাতের মতে, ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্যোগ আরও বাড়তে পারে। তাই এখন থেকেই প্রতিকার নিয়ে ভাবতে হবে। যেমন-বোরো ফসলের সময়কাল কমাতে পারলে কৃষকের কিছুটা উপকার হতে পারে। আইনুন নিশাত বলেন, ১৫ এপ্রিলের মধ্যে মাঠ থেকে বোরো ধান কেটে ফেলতে হবে। চৈত্র মাসের ফসল কাটা কিছুতেই যাতে বৈশাখ পর্যন্ত না যায়, সে পদ্ধতি বের করতে হবে। আমন ধানের বেলায় পানি নিষ্কাশন ও বন্যা ব্যবস্থাপনা দুটিই জোরদার করতে হবে। আগে আমাদের ফসল রোপণ ও ওঠানোর একটা সময় ছিল। একটা সিস্টেমের মধ্য দিয়ে সব হতো। এখন আর সেই সিস্টেম কাজে আসছে না। দিন দিন তা ভেঙে যাচ্ছে। ২০০৯ সালে প্রণীত জলবায়ু পরিবর্তন অ্যাকশন প্ল্যানে সব কিছুই বলা আছে। সেগুলোর বাস্তবায়ন করতে হবে। তার মতে, বৈশ্বিক উষ্ণতার যে প্রভাব সেটা লক্ষ করা যাবে আবহাওয়ার বিভিন্ন উপাদান দেখে। বাংলাদেশের কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা পুরোপুরি আবহাওয়ানির্ভর। ঘন ঘন ঘটতে যাওয়া দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারকে নতুন নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবনের পরামর্শ দেন তিনি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //